অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতা
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১২ এএম | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১২ এএম
নজিরবিহীন ঘটনা! ডিজিএফআই, এনএসআই; এসবির কঠোর নজরদারি, পুলিশ বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা; পরতে পরতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা; এত নজরদারির মধ্যেই দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড! এক জায়গায় নয়, সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের তিনটি স্পটে এক সাথে অগ্নিকাণ্ড! অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতা! রাজধানী ঢাকা যখন ঘুমিয়ে তখন হঠাৎ করে সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে চলছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সন্দেহ-সংশয় ও সন্দেহ। ইতোমধ্যেই সন্দেহের ডালপালা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত টিম গঠন করেছে ঠিকই; তবে এটি অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতাÑ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অকার্যকর করতেই কি এই বেনজির অগ্নিকাণ্ড! সর্বত্রই এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক। সচিবালয়ের অগ্নিকা-ের আগের দিন ইস্কাটন গার্ডেন রোডের সচিব নিবাসের ২০ তলা ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব কিসের আলামত? সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘আমাদের ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় নয়’। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে দিতে চায় কারা? যদি সে ধরনের কোনো অপচেষ্টা চলমান থাকে তাহলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করল? সচিবালয়ের এই অগ্নিকা-ের কয়েক ঘণ্টা আগে প্রশাসন ক্যাডার থেকে সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে সরকারকে হুমকি দিয়ে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে সচিবালয়ের অগ্নিকা-ের নেপথ্যে কোনো ষড়যন্ত্র নাকি নিছক অগ্নিকান্ড? কারণ অগ্নিকাণ্ডে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাগজ, নথি পুড়ে গেছে বলে জানা যায়।
পিলখানা হত্যাকা-সহ পতিত সরকারের নানা অনিয়মের তদন্তে যখন একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে তখনই দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে বুধবার মধ্যরাতে এই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভাতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে চারটি ফ্লোর পুড়ে গেছে। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে একসঙ্গে পৃথক পৃথক জায়গায় আগুন লাগায় এটিকে পরিকল্পিত নাশকতা বলেই মনে করা হচ্ছে। রিমোট কন্ট্রোল, ড্রোন কিংবা দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে নাশকতার উদ্দেশে আগুন লাগানো হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওই ভবনে ছিল অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান, যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, সড়ক পরিবহন সেতু বিভাগ। ভবনের পাঁচ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতর বুধবার রাতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর থেকে বাংলাদেশকে অকার্যকরী রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিশেষ একটি গোষ্ঠী একের পর এক কার্ড খেলছে। জুডিশিয়াল ক্যুর চেষ্টা, আনসার দিয়ে সচিবালয় ঘেরাও, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফেক নিউজ প্রচার, গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা, পাহাড়ে অশান্তি, হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অগ্নিসংযোগ, ধর্মীয় স্থানে অতর্কিত হামলা, সুউচ্চ ভবনে অগ্নিসংযোগ, রফতানিমুখী শিল্পের কনসাইনমেন্টে হামলা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দ্রব্যমূল্যের প্রাইস স্যাবোটাজ করার লক্ষ্যে সাপ্লাই চেইনে আঘাত, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশন/দূতাবাসে বিদ্রোহ সংঘটন (মিশন/দূতাবাস কর্তৃক অন্তর্বর্তী সরকারের বিপরীতে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ, সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর ভেতর উত্তেজনা সৃষ্টি, সাইবার আক্রমণ করে ওয়েব-নির্ভর বিভিন্ন সেবা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি, অর্থনৈতিক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ, ভাড়াটে ব্যক্তিদের সহায়তায় কৃত্রিম মবভায়োলেন্স সৃষ্টির চেষ্টা হয়। সর্বশেষ সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা, সরকারকে হুমকি ও আল্টিমেটাম। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্রই এসব নিয়ে চলছে বিতর্ক।
সচিবালয়ে ভয়াবহ এ আগুনের ঘটনার পর থেকে উদ্বেগ, শঙ্কা ও সন্দেহ দেশজুড়ে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে একই কথাÑ পতিত সরকারের দোসররা এর নেপথ্যে রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ দায়িত্বশীল কর্তারা তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আগুনের কারণ নিয়ে কিছু বলতে নারাজ। তবে এর মধ্যেই আগুনের ঘটনাটি নাশকতা এবং পরিকল্পিত বলে সন্দেহের তীর ছুড়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক ও ছাত্র-আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা। একই সুরে কথা বলেছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সচিবালয়ের ভেতরে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা নিয়েও। এছাড়া ভেতরে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দেশবাসী। অগ্নিকা-ের ঘটনায় তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়ে আগুন লাগিয়েছে বলেও মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তারা।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, সচিবালয়ে যেভাবে আগুন লেগেছে এবং এটার ধরন, অবস্থান যেমন, এটি কখনোই সাধারণভাবে বা ন্যাচারালি বা কোনো দুর্ঘটনাবশত আগুন হতে পারে না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, ষড়যন্ত্র করে, প্ল্যান (পরিকল্পনা) করে এই আগুনটি লাগানো হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে, দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে সংঘটিত আগুনকে পরিকল্পিত বলে সন্দেহ করছেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো অনেক ঘটনার ধারাবাহিকতা সচিবালয়ের এই অগ্নিকা-। তারা সরকার ও দেশবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, আগুনের ধরন ও অবস্থান, দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি এবং এর আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি তেলের জাহাজে আগুনের ঘটনা বিবেচনায় সচিবালয়ের অগ্নিকা-কে নাশকতা ছাড়া আর কিছু মনে করছেন না তারা। প্রকৃত ঘটনা জানতে দ্রুত সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তারা। রাজধানীতে সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামসজ্জিত জায়গায় আগুন লাগার ঘটনায় বিস্মিত মানুষ। সচিবালয়ে অফিস করতে আসা অনেক কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সচিবালয়ে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে একসঙ্গে ভবনের বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগবে, এটি তারা বিশ্বাস করেন না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান ইনকিলাবকে বলেন, এটি স্যাবোটাজ (নাশকতামূলক) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আগুনটা শর্টসার্কিট থেকে হলে একসঙ্গে তিন-চার জায়গায় লাগার কথা নয়। দুর্বৃত্তায়নে লাগানো আগুনেই এমনটি হয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান বলেন, আমি ভোর রাত থেকে এই আগুন ফলো করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি স্যাবোটাজ। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, এটি লাগানো আগুন, শর্টসার্কিটের আগুন কখনো এভাবে লাগে না। এর মধ্যে কাল তো সচিবালয় বন্ধ ছিল। সুতরাং সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেন, সচিবালয় তো রাষ্ট্রের ‘কি’ পয়েন্ট। কেপিআইভুক্ত এলাকা। যদিও এখানে আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছে। পিডব্লিউডি কাজও করেছে। আবার কেন তাহলে আগুন লাগল? আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এভাবে কখনো দুর্ঘটনার আগুন লাগে না। স্ট্যান্ডার্ট গার্মেন্টসে লাগা আগুনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, দুর্বৃত্তরা যখন আগুন লাগায় তখন একসাথে একাধিক স্থানে আগুন লাগে। এমন দুর্বৃত্তায়নের আগুন দেখেছি। এখানেও (সচিবালয়) তাই হয়েছে। এটি শর্টসার্কিট নয়, আগুন লাগানো হয়েছে।
নথি পোড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে : রাষ্ট্রের এমন স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আগুন লাগাটা কোনোভাবেই মানা যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আপনি জানেন, এখানে অনেক কিছু আছে চুরি হতে পারে, কিন্তু আপনি দরজা খুলে রাখলে হবে? এখানে তাই হয়েছে। এখানে এত এত গুরুত্বপূর্ণ নথি। সেখানে চুরি হতে পারে, স্যাবোটাজ হতে পারে। সেখানে তো নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। এখানে তো লোকাল গার্ড ছিল, নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো তাদের বিজনেসের অংশ। সেখানে সরকার পুলিশ কতক্ষণ থাকবে তার চেয়ে তো নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই রাখতে হবে। কে কে ছিল, কে ঢুকেছিল সেটি বের করতে হবে। আগুন যদি ছয় তলাতে হয়। সেটি কিন্তু রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও কোনো কিছু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে করা হতে পারে। ড্রোন ব্যবহার কিংবা মানুষ ঢুকছিল কিনা সেটির আলামত খুঁজতে হবে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করে তিনি বলেন, এখানে তো ফায়ার সার্ভিস ছিল। ভেতরে তো ফায়ার স্টেশন আছে। আর ক্যামেরাও তো আছে। সার্বক্ষণিক দেখভালের লোক আছে। সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে এক বা দুজন লোক ছিল না, দেড়-দুই শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী ছিল। তারা কি সবাই একসাথে ঘুমাচ্ছিল? সেটি তো হতে পারে না।
সচিবালয়ের আগুনকে সরাসরি নাশকতার অংশ হিসেবে দেখছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ। তিনি বলেন, এই আগুন স্যাবোটাজ, অবশ্যই এটি সন্দেহের শুরুতে রাখতে হবে। লাগানো আগুন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এটি কেপিআইভুক্ত এলাকা। আমাদের এখন চ্যালেঞ্জিং সময় যাচ্ছে। এটি ধরে নিতে হবে যে, এই আগুনের মোটিফ কী হতে পারে? এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে সচিবালয়ের চারটি ফ্লোরে আগুন, যেখানে চারটি কমিশন চলছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের নথিপত্রের প্রয়োজন হবে। এই আগুনের টার্গেটই হচ্ছে সেই গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়া। কারণ কমিশনের জন্য বিভিন্ন সময় নথিপত্রের প্রয়োজন হবে। যে উচ্চপদস্থ কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের সব কিছুর আগে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, এটি স্যাবোটাজ। যদি প্রথমেই ‘স্যাবোটাজ’ না ধরে তদন্ত করা হয় তাহলে ভুল হবে।
উৎসুক জনতার হাজারো প্রশ্ন : বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে লাগা আগুন সকাল ৮টা ৫ মিনিটের দিকেও পুরোপুরি নেভানো যায়নি। আরো প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে ভবনটির সম্পূর্ণ আগুন নির্বাপণ করা হয়। এতে ৭ নম্বর ভবনের ছয় থেকে ৯তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এ চারটি তলায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছাঁই হয়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল। চারটি ফ্লোরই একেবারে পুড়ে গিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একাংশ পুড়ে গেছে। পুড়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েরও কিছু অংশ। বেঁচে যাওয়া রুমগুলোতে অসংখ্য কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভবনটির নিচে পড়ে আছে মরা কবুতর। এদিকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলা হলেও কার্যত প্রায় ১০ ঘণ্টা লেগেছে আগুন পুরোপুরি নেভাতে। সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় সেখানের নিরাপত্তা জোরদার করতে বুধবার দিবাগত গভীর রাত থেকেই মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও এপিবিএন। জিপিও থেকে শিক্ষা ভবন পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাত ২টার পর থেকে সচিবালয়ের সামনের দুই পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু ফায়ার সার্ভিস ও আইশৃঙ্খলা বাহিনীর ছাড়া অন্য সব গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল।
এদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সকাল সাড়ে ৯টায় সাত নম্বর ভবনের চারপাশে দেখা যায় উৎসুক জনতার ভিড়। দফতরে ঢুকতে না পেরে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। সকাল সাড়ে ৯টার পর শুধু সংশ্লিষ্টদের সারিবদ্ধভাবে এক এক করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের সবগুলো প্রবেশপথ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে আগুন নেভাতে আসা ফায়ার ফাইটাররা বলেছেন, আগুন নেভাতে গিয়ে তাদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢোকাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের দুটি টার্নটেবল লেডার (টিটিএল) সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। যদি আরো বেশি টিটিএল ঢুকতে পারত, তাহলে আরো আগে আগুন নেভানো সম্ভব হতো। তারা বলেন, সচিবালয়ের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে গেছে।
সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকার প্রবেশ পথগুলো প্রশস্ত না থাকার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন উপস্থিত বিভিন্ন স্তরের লোকজন। আগুন নেভানোর কাজ শেষে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সচিবালয় থেকে বের করতেও বেশ সমস্যা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। গাড়ি বের করতে গিয়ে দেয়ালের কয়েকটি জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এর আগে বিভিন্ন সময় সচিবালয়ে ঢোকার ফটক সম্প্রসারণ করার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম তিন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার প্রতি বার্তা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে উদ্দেশ করে বলেন, সময় ফুরিয়ে গেছে। যখনই বিপ্লবীরা হাসিনার অপকর্ম, চুরি, লুটপাট, দুর্নীতির দিকে নজর দিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, তখনই সচিবালয়ে ঘাঁপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালরা বিভিন্ন অপকর্মের ফাইলগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দিলো।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। অগ্নিকা-ের ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বৃহস্পতিবার দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি করা হয়। এছাড়া আরো দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আগুন পরিকল্পিত কিনা সেটি তদন্তের পর বলা যাবে। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সচিবালয়ের আগুনকে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট নয়; বরং পরিকল্পিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভেতরের পরিস্থিতি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, কোনো শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগেনি। এখানে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে আগুনটা লেগেছে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার সার্ভিসের সদস্য সোহানুজ্জামান নয়ন মারা গেছেন। এই প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল জানান, পানির পাম্প থেকে লাইনের সংযোগ দিতে সড়ক পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কায় সোহানুজ্জামান নয়ন আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। কিভাবে আগুন লেগেছে তার রহস্য উদঘাটন করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অগ্নিকা-ের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটি নাশকতা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই এ ধরনের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ স্থান বেছে নেয়া হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে এক স্থান থেকে আগুনের লেলিহান শিখা বের হতো। কিন্তু আলাদা স্থানে আগুন লাগায় বিষয়টি হাল্কাভাবে নিচ্ছি না। ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করতে পুলিশের একধিক টিম কাজ করছে।
অগ্নিকা--কবলিত ভবনে সিসি ক্যামেরা মেলেনি : সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের ভেতরে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা বা ফুটেজ মেলেনি। তবে ভবনের বাইরে কিছু সিসি ক্যামেরা আছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অগ্নিকা-ের আগে-পরের ফুটেজ পাওয়া যায়নি। যদি ফুটেজ পাওয়া যায় তাহলে আগুনের রহস্য অনেকটা উদঘাটিত হবে।
র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনার পরপর র্যাবের গোয়েন্দারা ঘটনাস্থলে রয়েছে। তারা আগুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পায়নি গোয়েন্দারা। ডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা সচিবালয় ও আশপাশের এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছি। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তাও নেয়া হচ্ছে। তবে কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।
রোববারের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে তদন্ত কমিটি : সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি আগামী তিন দিন অর্থাৎ রোববারের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে অগ্নিকা-ের ঘটনার প্রকৃত কারণ নিরূপণে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ঢাবি ও বণিক বার্তার যৌথ আয়োজনে ৮ম নন-ফিকশন বইমেলা শুরু আগামীকাল
মঠবাড়িয়ায় মালয়শিয়া প্রবাসীর ঘরে ডাকাতি, বৃদ্ধাসহ ৩ নারী আহত
টুইটার থেকে এক্স ,ইলন মাস্কের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন যুগ
বিপুল পরিমাণ গাঁজা, ট্রাক ও ধানসহ নকলার মাদক কারবারিকে ফুলপুরে আটক
বিপিএলে অনিশ্চিত সাকিব নাম লেখালেন পিএসএলে
আলফাডাঙ্গায় চলছে হালি পেঁয়াজ লাগানোর মহোৎসব, শ্রমিকের অভাবে বাড়ছে চাষির খরচ
শ্রীনগরে পুকুর থেকে ভাসমান বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার
কলকাতায় দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা চিন্ময়ের আইনজীবী এবার জাতিসংঘে যাওয়ার হুমকি দিলেন
রোববার হারিছ চৌধুরীর পুনর্দাফন
চলছে বিক্ষোভ, তারেক রহমানকে স্মারকলিপি, জবির অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ
চীনে তৈরি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ
কোহলির আরও বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিল: পন্টিং
বান্দরবানে আগুন দিয়ে ১৭ ঘর পুড়ে দেয়ার সাথে জড়িত দের ছাড় দেয়া হবে না- পার্বত্য উপদেষ্টা
জাহাজ সেভেন মার্ডারের খুনি ধর্মান্তরিত ইরফানের অজানা কাহিনী
খুলনার তাবলীগ মসজিদ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল
দেশে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে? জামায়াত আমীরের প্রশ্ন
ভারতে ইসকন মন্দিরে চিন্ময়ের আইনজীবীর বৈঠক
নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের আইনগত কোনো বাধা নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল
শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের নৌ ধর্মঘট, বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম
বিএনপির সংস্কার চায় না, এ কথাটি সঠিক নয়: মির্জা ফখরুল